সুপেয় পানির পুকুর মাছ চাষের জন্য ইজারা
সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় ২৬টি পুকুর পুনঃখনন করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। পানি পরিশোধন করে পানের উপযোগী করতে পুকুরের তীরে বসানো হয় ফিল্টারের আদলে ট্যাংক। তবে পুনঃখনন করা সব কটি পুকুর অবৈধভাবে মাছ চাষের জন্য ইজারা দিয়েছে জেলা পরিষদ। প্রতিটি পুকুর ৪০ হাজার টাকায় ইজারা দেওয়া হলেও টাকা গ্রহণের কোনো রসিদ দেওয়া হয়নি।
গাইবান্ধা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কার্যালয় সূত্র জানায়, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় জেলা পরিষদের আওতাধীন ২৬টি পুকুর রয়েছে। ভূ–উপরিস্থ পানি ব্যবহারের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর পুকুর খনন, পুনঃখনন ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পের আওতায় এসব পুকুর পুনঃখনন করা হয়। ২০১৮ সালে পুকুরগুলো পুনঃখননের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। এ কাজ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার (জিওবি) দেড় কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। ২০২০ সালে পুকুরগুলোর পুনঃখননকাজ শেষ হয়।
ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইউনুছ অ্যান্ড ব্রাদার্স এই কাজের দায়িত্ব পায়। ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পাবনার শফিকুল ট্রেডার্স ও গাইবান্ধার শহিদুল ইসলাম প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করেন। ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি পুকুরগুলো জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একই বছরের ১৫ জুলাই জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহা. আবদুর রউফ তালুকদার সব কটি পুকুর মাছ চাষের জন্য ইজারা দেন। আবদুর রউফ তালুকদার স্বাক্ষরিত ইজারা দেওয়ার চিঠি ইজারাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছানো হয়। চিঠিতে প্রতিটি পুকুর ৪০ হাজার টাকায় ইজারা দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। তবে ইজারাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা হাতে হাতে টাকা জমা দিলেও টাকা গ্রহণের বিপরীতে তাঁদের কোনো রসিদ দেওয়া হয়নি।
গত বুধবার উপজেলার শাখাহার ইউনিয়নের অন্তর্গত আলীগাঁও নামের একটি পুকুর সরেজমিনে দেখা যায়, কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে পুকুর ঘিরে রাখা হয়েছে। পুকুরে প্রবেশপথে রয়েছে লোহার গেট। সেখানে টাঙানো সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, ‘ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে পুনঃখনন করা সংরক্ষিত পুকুর’। এ ছাড়া ওই পুকুরে গোসল করা, কাপড় কাচা, হাত-পা ধোয়া ও মাছ চাষ করা সম্পূর্ণ নিষেধ বলে সাইনবোর্ডে উল্লেখ করা হয়েছে।
পুকুরের তীরে ফিল্টারের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে ইটের তৈরি ট্যাংক। ট্যাংকে সংযুক্ত অগভীর নলকূপ। নলকূপ দিয়ে পুকুর থেকে ট্যাংকে পানি উঠে পরিশোধিত হয়ে পানের উপযোগী হবে। তবে দীর্ঘদিন এর ব্যবহার না হওয়ায় ট্যাংকের পাড়ে ময়লা–আবর্জনা জমে থাকতে দেখা গেছে। ইজারা দেওয়ার পর অন্যান্য এলাকার পুকুরের বিলবোর্ড ও বেড়া সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে জানা গেছে।
আলীগাঁও গ্রামের কলেজছাত্র এনামুল হক বলেন, পানির ব্যবহার শুরু না হতেই ইজারা দেওয়া হয়েছে। যাঁরা ইজারা নিয়েছেন, তাঁরা কাউকে পুকুরের পানি নিতে দিচ্ছেন না।
শাখাহার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তাঁদের এলাকাটি বরেন্দ্র এলাকা। এখানে পানির স্তর নিচে থাকায় শুকনা মৌসুমে নলকূপে পানি ওঠে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের এটা ভালো উদ্যোগ ছিল। কিন্তু মাছ চাষে ইজারা দিয়ে সেটা নষ্ট করা হয়েছে।
গোবিন্দগঞ্জ নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মতিন মোল্লা বলেন, আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য জেলা পরিষদের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রীর মহৎ উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
আলীগাঁও গ্রামের ওই পুকুর এক বছর আগে জেলা পরিষদের কাছে থেকে বিনা রসিদে ৮০ হাজার টাকায় মাছ চাষের জন্য ইজারা নেন বেলাল উদ্দিন (৫৫) নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ৪০ হাজার টাকায় পুকুরটি ইজারা নিয়েছেন। ইজারা পেতে তাঁকে অতিরিক্ত আরও ৪০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে গাইবান্ধা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ রেজওয়ান হোসেন বলেন, পুকুরের মালিক জেলা পরিষদ। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের দায়িত্ব ছিল পুকুর পুনঃখনন করা। এরপর এসব পুকুর মাছ চাষের জন্য ইজারা দেওয়ার ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না।
জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, জেলা পরিষদের সিদ্ধান্তে এসব পুকুর ইজারা দেওয়া হয়েছে। মাছ চাষে
ইজারা দেওয়ার নিয়ম নেই, প্রশ্ন করলে জেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
প্রায় তিন মাস আগে জেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান আতাউর রহমান সরকারের মেয়াদ শেষ হয়েছে। তবে পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত তিনি জেলা পরিষদের প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছেন। পুকুর ইজারার বিষয়ে জানতে চাইলে আতাউর রহমান বলেন, গোবিন্দগঞ্জে একটি পুকুর ইজারার কথা তিনি জানেন। ২৬টি পুকুর কীভাবে কে ইজারা দিয়েছে, সেটা তাঁর জানা নেই। তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বাস দেন।

Post a Comment
0 Comments